নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | প্রিন্ট
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলোপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারোয়ার ভূইয়া দ্বিতীয় মেয়াদে পুনঃনিয়োগ পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন। কোম্পানির পরিচালনা বোর্ড এমডি পদে পুনরায় তার নিয়োগ প্রস্তাব অনুমোদনের আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
জানা যায়, জনাব ভুইয়া ২০১৮ সালে ইয়াকিন পলিমার লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। এই ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মনীতির কোন তোয়াক্কা করা হয়নি। সকল নিয়মনীতি ভঙ্গ করে ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এই ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ গ্রহণকারী ইয়াকিন পলিমার লিমিটেড এবং সাতক্ষীরা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের দশটি একাউন্ট বি এল বা ব্যাড এন্ড লস অবস্থায় আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী ঋণ ক্লাসিফিকেশনের চারটি ধাপ আছে, এগুলো হচ্ছে এসএমএ বা স্পেশাল মেনশন একাউন্ট, এসএস বা সাবস্টান্ডার্ড, ডিএফ বা ডাউটফুল এবং বিএল বা ব্যাড এন্ড লস। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের তিনটি কিস্তি পরিশোধ করা না হলে ব্যাংক ঋণটি হবে এসএমএ এবং ছয়টি কিস্তি পরিশোধ করা না হলে এস এস শ্রেণিকরণ করতে পারে। এ অবস্থায় ব্যাংক চাইলে বিশেষ বিবেচনায় ওভারডিউ শোধ করা সাপেক্ষে নতুন করে ঋণ অনুমোদন করতে পারে। কিন্তু ডিএফ এবং বিএল থাকা অবস্থায় কোনভাবেই ঋণ দিতে পারে না।
২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর ইয়াকিন পলিমার লিমিটেডের নামে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সিআইবি রির্পোটে ছয়টি অ্যাকাউন্ট বিএফ বা ডাউটফুল অর্থাৎ সন্দেহজনক একাউন্ট এবং ২৬টি একাউন্ট এসএস বা সাবস্টান্ডার্ড হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এসএমএ এবং ইউসি বা আনক্লাসিফাইড অ্যাকাউন্ট দীর্ঘদিন নন পেমেন্ট অবস্থায় আছে। ব্যাংক চাইলে এই অ্যাকাউন্টগুলোকে বিএল বা ব্যাড এন্ড লস করতে পারে। সাতক্ষীরা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের অবস্থা আরো ভয়াবহ। সাতক্ষীরা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ও সিআইবি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে এ তথ্য জানা যায়। যার সাবজেক্ট কোড অ ০০০০২১৯১৩২৯। এতে দেখা যায়, এর দশটি অ্যাকাউন্ট ব্যাড এন্ড লস বা মন্দ ঋণে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু লোন একমাস পূর্বেও বিএল অবস্থায় ছিল।
এরকম একটা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার জন্য কিভাবে বিবেচনায় আনা হয় জানতে চাওয়া হলে আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সরোয়ার ভূইয়া বলেন, “এটা আমার একক সিদ্ধান্ত নয়, এখানে ঋণ বিতরণ কমিটি রয়েছে এই কমিটির সম্মতিক্রমে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।”
আইআইডিএফসির ঋণ বিতরণ কমিটির তৎকালীন একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ প্রতিনিধিকে বলেন, সভায় এই ঋণ প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনার সময়ে লিংকন মন্ডলসহ অন্য সদস্যরা সমর্থন করলেও তিনি এর বিরোধিতা করেন। এমডি এ ঘটনায় পরবর্তীতে আমাকে পদত্যাগ করতে বলেন। পদত্যাগ না করায় বেনিফিট আটকে দিয়ে এমডি আমার নামে মামলা করারও হুমকি দেন। আমি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করি। তবুও এমডির কথা মত এই ঋণ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করিনি।
এমডি কেন এই ঋণটি দেওয়ার জন্য অতিউৎসাহি ছিলেন, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “এটা খুব সহজ হিসাব, এখানে অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের বিষয় রয়েছে। এমডির সাথে কোন ধরনের আর্থিক লেনদেন না হলে এই ধরনের খারাপ গ্রাহককে কেন ঋণ দিবেন ?” তিনি আরো বলেন, “আমি আইআইডিএফসি থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে তার এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে লিখিত কমপ্লেইন জানিয়েছি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।” এত বড় অনৈতিক কর্মকান্ডের পরেও গোলাম সারোয়ার এমডি পদে কিভাবে বহাল থাকেন, এ প্রশ্ন এ খাতের সংশ্লিষ্টদের।
এ ধরনের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপর সাধারণ মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলছে। গোলাম সারোয়ারের দুর্নীতি শতভাগ প্রমাণিত হবার পরও তিনি কীভাবে চাকরিতে বহাল থাকেন। দুর্নীতিগ্রস্ত একজন এমডিকে কার স্বার্থে পুনঃনিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ সুপারিশ করা হয়। Ñএসব প্রশ্ন খাত সংশ্লিষ্টদের।
২০১৮ সালে ইয়াকিন পলিমার লিমিটেডের নামে বিতরণ করা ঋণ ২০২২ সালে ইন্টারেস্ট ব্লক করা হয়। তদুপরি সুদে আসলে ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় সাত কোটি ৫২ লাখ টাকারও বেশি। এ সময়ের মধ্যে ঋণের তেমন কোন কিস্তি আদায় হয়নি। ধুর্ত গোলাম সারোয়ার ভুইয়া বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ইয়াকিন পলিমার লিমিটেড এবং সাতক্ষীরা ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ক্লাসিফাইড অ্যাকাউন্টগুলোর টাকা পরিশোধ হয়েছে মর্মে সার্টিফিকেট দাখিল করেন। কোনো ধরনের ভেরিফাই ছাড়া দ্রুত অর্থ ছাড় করে দেন। নিয়ম হল ডিসবার্সমেন্ট এর পূর্বে এই সার্টিফিকেটগুলোকে অবশ্যই ভেরিফাই করতে হবে। কিন্তু আইআইডিএফসি থেকে ভেরিফাই করা হয়নি, ভেরিফাই করা হলে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্ভার থেকে নামানো সিআইবিটিতে দেখা যায়, আগের একাউন্টের অনেক অ্যাকাউন্ট বিএল বা ব্যাড এন্ড লস স্ট্যাটাস থেকে যায়। পেমেন্ট সার্টিফিকেট গুলো যদি সঠিক হতো তাহলে সিআইবি রিপোর্টে কখনোই বিএল বা ব্যাড এন্ড লস আসতো না। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক গোলাম সারোয়ার ভুইয়ার নিয়োগ অনুমোদন না করাকে স্বাগত জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
Posted ৭:১৩ অপরাহ্ণ | রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
desharthonity.com | Rina Sristy