নিজস্ব প্রতিবেদক | সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩ | প্রিন্ট
ডলারের বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের জোরালো তৎপরতার মধ্যেই দুঃসংবাদ হয়ে এল রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে, যা গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে কভিডসৃষ্ট দুর্যোগের মধ্যে ১০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গতকাল রেমিট্যান্সের এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
গত আড়াই বছরে ২৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বিদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়ায় দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার কথা। কিন্তু চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই রেমিট্যান্সে নিম্নমুখী প্রবাহ অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৯১ কোটি ৬২ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ৫৬৭ কোটি ২৮ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছিল। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহে এ ধারাবাহিক বিপর্যয় এমন সময়ে হচ্ছে, যখন দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। আমদানি ১৫ শতাংশের বেশি কমিয়ে আনা সত্ত্বেও বেশির ভাগ ব্যাংক যথাসময়ে ঋণপত্রের (এলসি) দায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জ্বালানি তেল, সারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার সহায়তা দিতে হচ্ছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও উল্লেখযোগ্য হারে ক্ষয় হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘রেমিট্যান্স পতনের বিষয়টি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরে আছে। কেন এত পরিমাণ রেমিট্যান্স কমছে, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে বলা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক সবসময়ই বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার শুরুটা গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে। ওই সময় আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ বিনিময় হার বেঁধে দেয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশি দামে ডলার বেচাকেনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশী-বিদেশী ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণও করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তৎপরতার মুখেই গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় রেমিট্যান্স ৫০ কোটি ডলার কমে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এলেও সেপ্টেম্বরে তা ১৫৩ কোটি ডলারে নেমে আসে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কঠোর হয়েছে, তখনই বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় দেখা গেছে।
বর্তমানেও বেশি দামে ডলার বেচাকেনা ঠেকাতে দেশের ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান বিশেষ অভিযানের মধ্যেই রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে।
দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেছেন, ডলারের বাজার স্থিতিশীল করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভুল নীতিতে চলছে। বাস্তবতা না বুঝেই বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। ব্যাংক নির্বাহীরা নির্ভয়ে কোনো পরামর্শও দিতে পারছে না। এ কারণে রেমিট্যান্সের বাজার এতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘দেশে হুন্ডির বাজার এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণকারীরাও অনেক প্রভাবশালী। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো প্রভাবশালী হুন্ডি কারবারিদের বিরুদ্ধে কিছুই করছে না। তারা ভাসমান বিদেশী মুদ্রা বিক্রেতা ও কিছু মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালিয়ে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এ ধরনের লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।’
ব্যাংক খাতে গতকাল প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ছিল ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) প্রতি ডলার ১১৭-১১৮ টাকায় লেনদেন হয়েছে। ব্যাংকের তুলনায় খুচরা বাজারে বেশি দাম পাওয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশীরা হুন্ডির মাধ্যমে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহের বিপর্যয় থামানো যাবে না বলে জানান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের বিনিময় মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আবার ধীরে ধীরে ডলারের বিনিময় হারও বাড়ানো হচ্ছে। ব্যাংকে ডলারের দাম বাড়লে কার্ব মার্কেটেও বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে ডলারের বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব হবে না। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে হলে প্রভাবশালী হুন্ডি কারবারিদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হলে তবেই হুন্ডির বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে।’
আমদানি দায় মেটানোর পাশাপাশি বিদেশী ঋণ পরিশোধের চাপে রয়েছে বাংলাদেশ। ডলারের সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও প্রতিনিয়ত ক্ষয় হচ্ছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার ১১৫ কোটি বা ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সে হিসাবে গত দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ অর্ধেকেরও অনেক নিচে নেমে এসেছে।
দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আসত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩৪ কোটি ডলার। যদিও দুই বছর আগে ব্যাংকটির মাধ্যমে মাসে ৬০ কোটি ডলারও রেমিট্যান্স এসেছিল।
জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সারা বিশ্বেই এখন হুন্ডির বাজার বেশ শক্তিশালী। এ কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। জাতীয়ভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রভাব ইসলামী ব্যাংকের ওপরও পড়েছে। আমরা রেমিট্যান্স বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবাসীরা রেকর্ড ২ হাজার ৪৭৭ কোটি বা ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স কমে ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত অর্থবছরে দেশে মোট রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। গত দুই অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থবিরতা চললেও এ সময় বিদেশগামী অভিবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, শুধু চলতি ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৬ লাখ ১৭ হাজার ৫৭৬ জন বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে বিদেশ গেছেন। ২০২২ সালে বিদেশগামী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। এর আগে ২০২১ সালেও ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন। সব মিলিয়ে গত আড়াই বছরে বিদেশের শ্রমবাজারে নতুন করে ২৩ লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ জন বাংলাদেশী যুক্ত হয়েছেন। এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী বিদেশ গেলেও রেমিট্যান্স প্রবাহে সেটির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
Posted ২:১২ অপরাহ্ণ | সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩
desharthonity.com | munny akter