সোমবার ২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দেড় হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি

নিজস্ব প্রতিবেদক   |   বুধবার, ১০ মে ২০২৩ | প্রিন্ট

দেড় হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি

বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যের মূল্য বেড়েছে। আমদানির তুলনায় রপ্তানি কম হওয়ায় বড় বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬১ কোটি ডলার।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৫ হাজার ৩৯৩ কোটি ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৯ মাসে ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।

এছাড়া আমদানির বিপরীতে এসময় রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৯৩২ কোটি ডলারের পণ্য। যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। গত বছর একই সময়ে ৩ হাজার ৬৪৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিলো।

টানা বড় অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিলেও কয়েক মাসে এর পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এলসি খোলা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কারণে এমন সফলতা এসেছে। অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় ধীরে ধীরে আমদানি ও রপ্তানির ব্যবধান কমে আসছে। এসব পদক্ষেপের কারণে আগামীতে ঘাটতি আরও কমে আসবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

এদিকে ডিসেম্বর শেষে দেশে বাণিজ্য ঘাটতি ছিলো ১ হাজার ২৩০ কোটি ডলার। মার্চ শেষে যার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৬১ কোটি ডলার। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩১ কোটি ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে সেবা খাতে দেশের আয় হয়েছে ৬৫০ কোটি ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে দেশের ব্যয় ৯৪০ কোটি ডলার। এতে সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৮৯ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিলো ২৭৯ কোটি ডলার।

চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। কিন্তু দেশে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স এখন ঋণাত্মক। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে ৩৬৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিলো ১ হাজার ৪৩৪ কোটি ডলার।

এছাড়া সামগ্রিক লেনদেনেও বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। মার্চ শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ৮১৬ কোটি ডলারে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে (ঋণাত্মক) ৩০৯ কোটি ডলারের ঘাটতি ছিলো।

তবে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই বেড়েছে। আলোচ্য এই ৯ মাসে এফডিআই এসেছে ৩৭৮ কোটি ডলার। যা এর আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ৩৫৩ কোটি ডলারের বিনিয়োগ এসেছিলো।

এদিকে গত বছরের শুরু থেকেই দেশে ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমছে ধারাবাহিকভাবে। ডলার সংকট কাটাতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে চাপ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভের পরিমাণও কমছে ধারাবাহিকভাবে। অর্থবছরের শুরুতে রিজার্ভ ছিলো ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বর্তমানে তা কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে।

বিশ্ব মন্দায় কমছে আমদানির জন্য এলসি
প্রভাব পড়ছে উৎপাদনে
নিজস্ব প্রতিবেদক : আমদানির উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে চলতি অর্থবছরের ২০২২-২৩ সালের জুলাই-মার্চ সময়ের মধ্যে আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার প্রায় ২৫.৩৮ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ ২০২২-২৩ অর্থ বছরের জুলাই-মার্চে ৫১.৩৬ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা ২০২১-২২ সালের একই সময়ে ছিল ৬৪.৮৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ উল্লেখিত সময়ে এলসি করেমছে ১৭.৪৮ বিলিয়ন ডলার।
এক তথ্যে দেখা যায় ডলার-সংকট, ডলারের ওপর চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়াকড়ি এবং বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তার কারণে শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানি ব্যাপক হারে কমেছে।
ব্যাংকাররা বলেছেন বাজারে ডলারের ঘাটতির কারণে আমদানি ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা অনেক ব্যবসায়িকে আমদানি কমাতে বাধ্য করেছে।
এরপরও ডলার সংকটের সাথে লড়াই করে বেশ কয়েকটি ব্যাংক তাদের এলসি খোলার বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে অক্ষম ছিল, এতে নতুন এলসি খোলার পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
বিশ্ব মন্দার কারনে শিল্প স্থাপনে নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের উদ্যোগও কমে গেছে। এতে গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৪ শতাংশ। একই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশ।
এদিকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ভাটা এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার প্রভাবে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন ২০২৩ সালে রপ্তানি কমে যাবে। এতে নতুন কর্মসংস্থান হবে না, বরং কারখানয উৎপাদন অব্যাহত না থাকায় কর্মসংস্থান এর উপর প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায় গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয় ২১৪ কোটি ডলারের। গত বছরের একই সময়ে এ খাতে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৪৬৬ কোটি ডলারের। ফলে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৫৪ দশমিক ১১ শতাংশ। একই সময়ে ঋণপত্র খোলার পাশাপাশি ঋণপত্র নিষ্পত্তিও কমেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, এ সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তির হার কমেছে ১৩ দশমিক ৪২ শতাংশ।

উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমান অস্থির সময়ে কেউ নতুন করে বিনিয়োগ করার সাহস দেখাচ্ছে না। তাঁদের কথায়, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে বর্তমানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার ক্রয়াদেশও ভালো নেই।
মূলধনি যন্ত্রের পাশাপাশি শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচামাল আমদানিও কমে গেছে এই সময়ে। গত জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছে ১৫৫ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২২২ কোটি ডলার। অর্থাৎ কাঁচামাল আমদানি ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩০ শতাংশ। একইভাবে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসা সম্প্রসারণ নেই বললেই চলে। কারণ, গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে, তা-ও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এর ফলে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল দুটোরই আমদানি কমে গেছে।
তিনি বলেন বলেন, ‘২০২৩ সালে রপ্তানি কমে যাবে। নতুন কর্মসংস্থান হবে না, বরং কারখানা বন্ধের ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। গত সপ্তাহেও তিনটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আশা করি ২০২৪ সালে আবার খাতটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।’
এদিকে আমদানি কমায় ও নতুন শিল্পঋণের চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যাংকের ঋণপ্রবাহ কমে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এখন নতুন করে কোনো প্রকল্প যেমন তাঁরা নিচ্ছেন না, তেমনি আবার শিল্পের নিয়মিত সংস্কার ও সম্প্রসারণও কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মার্চে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে হয়েছে ১২ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ, জানুয়ারিতে যা ছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যমানের ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হলে তা আটকেও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার-স্বল্পতার কারণে অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ঋণ কমেছে।
ব্যাংকাররা আরও বলছেন, ব্যাংকেও টাকার টানাটানি রয়েছে। ফলে বেছে বেছে ভালো ব্যবসায়ী ছাড়া অন্যদের ঋণ দেওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে সব ব্যাংকই এখন এসএমই ও রিটেইল ঋণের দিকে ঝুঁকছে।

এদিকে রিটেইল ঋণে ব্যাংকঋণের সুদহার ১২ শতাংশ পর্যন্ত নেওয়ার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই তুলনায় শিল্পঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় ও অস্থিরতার কারণে মূলধনি যন্ত্র ও কাঁচামাল আমদানি কমে গেছে। এর ফলে বেসরকারি খাতের ঋণ কমছে। তিনি মনে করেন, এতে অর্থনীতির গতি কমে যেতে পারে। শিল্প খাতে ব্যাংকের যে ঋণ রয়েছে, তা আদায়ের ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়তে পারে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

Facebook Comments Box
advertisement

Posted ৮:১২ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১০ মে ২০২৩

desharthonity.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

advertisement
advertisement
advertisement

ক্যালেন্ডার

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক
গোলাম ফারুক
Contact

সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: পিএইচপি টাওয়ার, ১০৭/২, কাকরাইল, ঢাকা-১০০০।

Phone: 01759881611

E-mail: editor@desharthonity.com