নিজস্ব প্রতিবেদক | রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৩ | প্রিন্ট
অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের গ্রীষ্মকালে চলছে প্রচণ্ড তাপদাহ। জলবায়ুর এই অস্বাভাবিক আচরণে বিপর্যস্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এ অবস্থায় ভালো নেই দেশের চা শিল্পাঞ্চলও। চা বাগানের কোনো কোনো সেকশনে (চা আবাদের নির্দিষ্ট এলাকা) গাছে দেখা দিয়েছে নানান ব্যাধি।
চা গাছে কুঁড়িহীন অবস্থা তৈরি হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে কুঁড়ি বৃদ্ধির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কোথাও কোথাও চা গাছ ধূষর হয়ে গেছে। এ অবস্থায় চায়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ফিরিয়ে আনতে নতুন চারাগুলোতে ইরিগেশন বা কৃত্রিম সেচের পরামর্শ দিয়েছেন চা বিশেষজ্ঞরা।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের আবহাওয়া সহকারি মুজিবুর রহমান অত্যাধিক তাপমাত্রার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, চলতি এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছিল। এমন অত্যাধিক তাপমাত্রা জনজীবন ও প্রকৃতিতে নানান সমস্যার সৃষ্টি করে। বেশ কিছু ধরে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা চলছে বলেও জানান তিনি।
চা বাগান ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন সেকশনে নতুন আসা কুঁড়িগুলো কোথাও এক সাপ্তাহ ধরে একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে। কোথাও কোথাও কুঁড়িগুলো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কোথাও আবার পাতা ঝিমিয়ে পড়েছে। চায়ের জন্য পরিমিত বৃষ্টি না পেলে দেখা দিতে পারে উৎপাদন ঘাটতি। তবে এ থেকে স্থায়ী সমাধানের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থাপনা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন চা সংশ্লিষ্টরাদের।
চা বাগানের সেকশনে একটা অংশ ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া সম্পর্কে নাহার চা বাগান এবং জুলেখানগর চা বাগানের ম্যানেজার ইবাদুল হক বলেন, এই সমস্যাটা হলো রেডস্পাইডার বা লালমাকড়সার কারণে। এই গরমে রেডস্পাইডার ডিম পাড়ে সেই ডিমের হ্যাচিংয়ের (ফুটন) কারণে হয়েছে। সেই ডিম থেকে বাচ্চা দ্রুত বের হয়। রেডস্পাইডার বা লালমাকড়সা চা পাতাগুলোর ‘ক্লোরোফিল’ বা রস খেয়ে ফেললে পাতার অবস্থা এমন হয়ে যায়।
কুঁড়িহীন ডালের উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, এ সমস্যা দুটো কারণে হতে পারে। প্রথম কারণ হলো ছত্রাকজনিত রোগ লিব্রাস্টের প্রকোপ। এটা হলে গাছের পাতাগুলো সব অনায়াসে ঝরে যায়। গাছে কোনো পাতা দেখা দেয় না। অপর কারণ, লোপার নামক এক ধরনের কীট গাছের পাতার কুঁড়িগুলো সব খেয়ে ফেলে। এই দুটো কারণে হতে পারে। লোপার হলো প্রজাপতির জীবনচক্রের অসম্পূর্ণ অংশ। সেটাতে আমরা সহজ বাংলায় বিছাপোকা বা শূয়োপোকা বলি। প্রচণ্ড সূর্যতাপে চা বাগানের এই সমস্যাগুলো হয়। তবে বৃষ্টিপাত নিয়মিত হলো অতিরিক্ত গরম কমে আসলে ধীরে ধীরে এ সমস্যাগুলো ঠিক হয়ে যায়। এ ছাড়াও কীটনাশক ব্যবহার করলে এই সমস্যা কমে যায়।
এখন যেহেতু তাপমাত্রা খুব বেশি। এখন দিনের তাপমাত্রা ৩৭ বা ৩৮ ডিগ্রির মতো। এটা যদি ৩৪ এর উপরে যায় তখন চা গাছের সালোক সংশ্লেষণ থেমে যায়। চা গাছ তার শারীরিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, গাছের পাতা বাড়ে না।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের আওতাধীন প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট (পিডিইউ) এর পরিচালক ড. রফিকুল হক বলেন, বর্তমানের এ তাপদাহ চায়ের জন্য ক্ষতিকর। চায়ের সুনির্দিষ্ট টেম্পারেচার (তাপমাত্রা) আছে। যেমন- ৩০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত চা গাছ খুব ভালো উৎপাদন দিতে সক্ষম। ৩০ থেকে ৩৩ বা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাঝারি উৎপাদন দেয়। কিন্তু ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পরে চা গাছগুলোর উৎপাদন একদম কমে যায়।
চা গাছের খাদ্য তৈরির পদ্ধতি হলো গাছগুলো তার মূল থেকে পানি আহরণ করে এবং পাতাগুলো সূর্যালোক থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্যউপাদান সংগ্রহ করে। পরিবেশ অতিরিক্ত তাপমাত্রায় গিয়ে পৌঁছালে চা গাছগুলো আর খাদ্য তৈরি করতে পারে না। ফলে নতুনভাবে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি আর বের হয় না।
তিনি বলেন, এই অত্যাধিক তাপমাত্রার বিষয়ে চা বাগানগুলোকে আমরা পরামর্শ দিয়ে থাকি নতুন যে চা চারাগুলো লাগানো হয়েছে তার নিচে কচুরিপানা দিতে হবে এবং প্রতিটি সেকশনে নতুন চারার ক্ষেত্রে ইরিগেশনের (কৃত্রিম সেচ) ব্যবস্থা করতে হবে। চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের বাগানে শেডট্রি (ছায়া) তেমন একটা লাগাতেন না। কিন্তু বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এখন প্রোপার শেডট্রি লাগাতে হবে। নয়তো চা বাঁচানো সম্ভব হবে না। এজন্য আমরা প্রতিটি বাগানকে ২০ ফুট দূরে দূরে স্থায়ী শেডট্রি (স্থায়ী ছায়াবৃক্ষ), ১০ ফুট দূরে দূরে অস্থায়ী ছায়াবৃক্ষ লাগাতে বলেছি। চা গাছে তাপমাত্রা দরকার আছে। কিন্তু অতিরিক্ত তাপমাত্রা নয়। ৭০ ভাগ তাপমাত্রা দরকার। এই ছায়াবৃক্ষগুলো অতিরিক্ত সূর্যালোককে বাঁধা দিয়ে চা গাছের জন্য উপযোগী আলো ছড়িয়ে দেয়। তা না হলে এই অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে তারা প্রচণ্ডভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হবেন।
আরেকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে ড. রফিকুল হক বলেন, আগে চা বাগানগুলোতে বেশি পরিমাণে ক্লোন চা লাগাতো। এখন আমরা চা বাগানগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি ৫০ ভাগ ক্লোন চা এবং ৫০ ভাগ সিডলিং চা লাগানোর জন্য। ক্লোন চা গাছের মূলগুলো উপরে থাকে আর সিডলিং চা গাছের মূলগুলো মাটির গভীরে চলে যায়। ফলে গাছ তার প্রয়োজনীয় পানি মাটির নিচ থেকে সহজে শোষণ করে নিতে পারে।
Posted ২:০০ অপরাহ্ণ | রবিবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৩
desharthonity.com | Rina Sristy