নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিঃ (পিজিসিবি) জুনিয়র তড়িৎবিদ পদে জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া সনদে চুক্তি ভিত্তিক চাকরিতে যোগদানের অভিযোগে মো. শামছুর রহমানের (৪৩ ), বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ওয়াহিদুজ্জামান (৫৯) এবং ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার ৫নং কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাড. সালাউদ্দিন জোয়াদ্দার মামুনের(৪৮) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক জি এম আহসানুল কবীর বাদী হয়ে ২৯ মার্চ দুদক সজেকা ঢাকা-১ এ একটি মামলা দায়ের করেছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। বর্তমানে জুনিয়র তড়িৎবিদ মো. শামছুর রহমানের নিয়োগ পত্র ও চাকরি চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।
গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা ও উপ পরিচালক মুহাম্মদ আরিফ সাদেক। মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১ সালে ২৭ জুন থেকে ২০১৩ সালের ১২ মে’র মধ্যে অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার অভিপ্রায়ে পরস্পর যোগসাজসে প্রতারনা, জালিয়াতি ও অসদাচরনের মাধ্যমে প্রকৃত জন্ম তারিখ গোপন করে ভুয়া বয়স সম্বলিত সনদপত্র সৃজন ও ব্যবহার করে ‘টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্ট’ পদে পাওয়ার গ্রীড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিঃ, ঢাকায় চাকুরির ব্যবস্থা ও গ্রহণ করে মো. শামছুর রহমান। অভিযুক্তরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপরব্যবহার, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জাল সনদ তৈরি ও ব্যবহারের মাধ্যমে ওই পদে চাকরিতে যোগদান এবং সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। বিধায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মামলা আরও উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযুক্ত মো. শামছুর রহমান ১৯৯০ সালে বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শৈলকুপা, ঝিনাইদহে ৬ষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি হন। তিনি উক্ত বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক শিক্ষা (নবম-দশম শ্রেণি) এর ১৯৯৩-১৯৯৪ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন। তার কোন প্রমাণ ছিল না। তিনি ১৯৯৫ সালে উক্ত বিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসেবে যশোর বোর্ড থেকে প্রথম শ্রেণিতে এসএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিঃ (পিজিসিবি)-এর বিভিন্ন প্রকল্পে ‘কাজ নাই, বেতন নাই’ ভিত্তিতে গাড়ি চালক পদে চাকুরি করেন।
পিজিসিবি’র জিএমডি, চট্টগ্রাম (উত্তর) দপ্তরে ড্রাইভার পদে যোগদানকালীন তিনি জীবন-বৃত্তান্তের সাথে এসএসসি পাসের সনদ, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করেন। দাখিলকৃত প্রতিটি ডকুমেন্টে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ ২৪/০৬/১৯৮০ইং।
পিজিসিবি’র প্রকল্পে কর্মরত থাকাবস্থায় গত ২৮/১২/২০১১ইং পিজিসিবি’র রাজস্ব খাতের ‘টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্ট’ পদে জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। উক্ত বিজ্ঞপ্তির আলোকে তিনি গত ২৬/০১/২০১২ ইং উক্ত পদে নিয়োগ লাভের জন্য আবেদন করেন। উক্ত পদে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয়েছিল অষ্টম শ্রেণি পাশ এবং সাধারণ প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ০১/০১/২০১২ ইং সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩০ বছর। উক্ত তারিখে জনাব মোঃ শামছুর রহমানের বয়স ৩০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ায় তিনি সাহাপুর আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়, ডাকঘর: সাহাপুর, থানাঃ ঈশ্বরদী, জেলা: পাবনা এর ৮ম শ্রেণি পাসের একটি ভুয়া সনদপত্র দাখিলের মাধ্যমে পিজিসিবিতে চাকুরির জন্য আবেদন করেন। উক্ত সনদপত্রে তার জন্ম তারিখ উল্লেখ ছিল ২৪/০৬/১৯৮২ ইং। পরবর্তীতে পিজিসিবি’র নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় গত ২২/০৪/২০১৩ ইং তার নামে নিয়োগ পত্র ইস্যু করা হয়। নিয়োগ পত্রের নির্দেশনা মোতাবেক তিনি গত ১২/০৫/২০১৩ ইং পিজিসিবি’র জিএমডি, ঢাকা সেন্ট্রাল দপ্তরে টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্ট পদে যোগদান করেন। উক্ত পদে যোগদানের পর প্রত্যেক পিজিসিবি’র টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্টদের স্ব স্ব কর্মস্থল থেকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের ব্যবস্থা করা হয়। ইতোমধ্যে জনাব মো. শামছুর রহমান তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওয়াহিদুজ্জামানের কাছ থেকে গত ২৭/০৬/২০১১ ইং স্বাক্ষরে ১৯৯৪ সালে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের একটি ভুয়া সনদ সংগ্রহ করেন। তিনি গত ১৫/০৯/২০১৩ ইং পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করে তার কর্তৃপক্ষ বরাবর দাখিল করেন। পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে তিনি তার শিক্ষাগত যোগ্যতা ৮ম শ্রেণি পাস উল্লেখ করলেও বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেন বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কাঁচেরকোল, শৈলকুপা, ঝিনাইদ এবং উক্ত বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত সনদপত্র পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দাখিল করেন। অর্থাৎ তিনি চাকুরির মূল আবেদনের সঙ্গে সংযুক্ত সাহাপুর শহীদ আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটির তথ্য পুলিশ ভেরিফিকেশন ফরমে গোপন করে পরিকল্পিতভাবে বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ সংযুক্ত করেন। তার মূল আবেদন পত্র পিজিসিবি’র প্রধান কার্যালয়ে সংরক্ষিত থাকায় এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়াটি তার কর্মস্থল জিএমডি, ঢাকা সেন্ট্রাল থেকে সংঘটিত হওয়ায় তিনি উল্লিখিত প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ পান মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। পুলিশ ভেরিফিকেশন প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর তার চাকুরির চুক্তি স্থায়ীকরণ করা হয়।
পরবর্তীতে গত ০৮/০৩/২০২১ ইং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হলে পিজিসিবি’র বিভাগীয় তদন্ত কমিটির তদন্তকালে তার চাকুরি আবেদনের সঙ্গে দাখিলকৃত সাহাপুর আবুল কাশেম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসামী (২) মো. ওয়াহিদুজ্জামান কর্তৃক গত ২৭/০৬/২০১১ ইং স্বাক্ষরিত বিদ্যালয়ের স্মারক নং ১৩/৯০ তারিখ ২৭/০৬/১১ মূলে প্রদত্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদটিও সঠিক নয়। আসামী (১) মো. শামছুর রহমান উক্ত বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সহায়তায় অসৎ উদ্দেশ্যে উক্ত সনদটি সৃজন ও গ্রহণ করেন। প্রকৃতপক্ষে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জনাব মোঃ শামছুর রহমান ১৯৯২ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলেও সনদটিতে ১৯৯৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তার প্রকৃত জন্ম তারিখ ২৪/০৬/১৯৮০ইং হলে ২৪/০৬/১৯৮২ ইং লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে, পিজিসিবি’র বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে বিদ্যালয়ের প্যাডে গত ২২/০৮/২০২১ ইং লিখিত বিবৃতিতে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দাবী করেন যে, জনাব মোঃ শামছুর রহমানের নামে ই স্যুকৃত সনদটি যথাযথ আছে। তিনি বিবৃতিতে আরো উল্লেখ করেন যে, জনাব মোঃ শামছুর রহমান ঐ বিদ্যালয় হতে ১৯৯৪ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।
বিদ্যালয়ের রেকর্ড অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ২৪/০৬/১৯৮২ ইং। প্রকৃতপক্ষে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসামী (২) মো. ওয়াহিদুজ্জামান কমিটিকে ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য প্রদান করে বিবৃতি দেন। অনুসন্ধানকালে প্রধান শিক্ষক আসামী (২) মো. ওয়াহিদুজ্জামান এই মর্মে বিবৃতি দেন যে, বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি এ্যাড. সালাউদ্দিন জোয়াদ্দার মামুন, চেয়ারম্যান, ৫নং কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদ, শৈলকুপা, ঝিনাইদহ ও দলীয় লোকজনের চাপে তিনি উল্লিখিত সনদটি প্রদানে বাধ্য হন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক সনদ গ্রহণকালে তার কর্তৃক জন্ম নিবন্ধন সনদ প্রদর্শনের বিষয়ে যে তথ্য দেন তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। কারন অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কাঁচেরকোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় জন্ম নিবন্ধন করান গত ২৭/১৬/২০১২ খ্রি. তারিখে। অন্যদিকে, তাকে ৯ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণের প্রত্যয়ন প্রদান করা হয় গত ২৭/০৬/২০১১ ইং। উক্ত জন্ম সনদ ব্যবহার করে পরবর্তীতে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করেন মর্মে প্রতীয়মান হয়। অনুসন্ধানকালে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জনাব মোঃ শামছুর রহমান ১৯৯৫ সালে এসএসসি পাসের সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি দাবী করেন যে, এসএসসি পাস সনদে তার জন্ম তারিখ ভুল ছিল। জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে তিনি তার জন্ম তারিখ সংশোধন করেন।
অনুসন্ধানকালে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জনাব মো. শামছুর রহমান কর্তৃক ভুয়া ও জাল সনদপত্র দাখিলের মাধ্যমে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিঃ (পিজিসিবি) এ চাকুরি গ্রহণের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এভাবে, আসামী (১) মো. শামছুর রহমান, জুনিয়র তড়িৎবিদ, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিঃ (পিজিসিবি) [বর্তমানে নিয়োগ পত্র ও চাকুরী চুক্তি বাতিল করা হয়েছে), পিতা: মুন্সী হারুন কবীর, মাতাঃ মোছাঃ ফাতেমা বেগম; বর্তমান ঠিকানা: সি-১/৩, পিজিসিবি আবাসিক কলোনী, ব্লক-বি, এভিনিউ-৩, জহুরুল ইসলাম সিটি, আফতাব নগর, বাড্ডা, ঢাকা- ১২১২; স্থায়ী ঠিকানা: গ্রাম ও ডাকঘর: কাঁচেরকোল, উপজেলা- শৈলকুপা, জেলা- ঝিনাইদহ, জাতীয় পরিচয়পত্র নং ৮২৪১৬৩১৪১৮ প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভুয়া সনদ ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানী অব বাংলাদেশ লিঃ (পিজিসিবি) এর টেকনিক্যাল এ্যাটেনডেন্ট পদে চাকুরি নিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হয়েছেন।
আসামী (২) মো.ওয়াহিদুজ্জামান, প্রধান শিক্ষক, বেণীপুর বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ডাকঘর: উত্তর কচুয়া (সাবেক ডাকঘর: কাঁচেরকোল), উপজেলা: শৈলকুপা, জেলা: ঝিনাইদহ; পিতা: আফজাল হোসেন (মৃত), মাতা: শামসুন নাহার; স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা: গ্রাম ও ডাকঘর- বসন্তপুর, উপজেলা: শৈলকুপা, জেলা: ঝিনাইদহ জাতীয় পরিচয়পত্র নং ১৯৪১৫৮৩৪৮৪ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভুয়া তথ্য সম্বলিত সনদ সৃজন ও প্রদান করে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট জনাব মো. শামছুর রহমানকে পিজিসিবিতে অবৈধভাবে চাকুরি গ্রহণে সহযোগিতা করেছেন।
Posted ৫:২৫ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ ২০২৩
desharthonity.com | Rina Sristy