নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩ | প্রিন্ট
হোমল্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্সের গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা তদন্তে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে (আইডিআরএ) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে দুদক বরাবর হোমল্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্সের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের একটি আবেদন আগামী দুই মাসের মধ্যে ইতিবাচকভাবে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়ও আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে গ্রাহকদের পুরো অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ কেনো দেওয়া হবে না, সংশ্লিষ্টদের জবাব চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। আগামী ৪ জুন মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে’ বলেও জানান আইনজীবী।
বুধবার (২৯ মার্চ) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৪ গ্রাহকের পক্ষে রহিমা আক্তারের করা রিটের শুনানি নিয়ে রুলসহ এ আদেশ জারি করেনে।
রিটে অর্থসচিব, ইন্সুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির চেয়ারম্যান, দুদক চেয়ারম্যান, হোমল্যান্ড ইন্সুরেন্সের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ প্রতিষ্ঠানের ১৪ পরিচালককে বিবাদী (রেসপনডেন্ট) করা হয়।
রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মো. রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট আক্তার রসুল মুরাদ, আব্দুল্লাহিল মারুফ ফাহিম ও মো. দিদারুল আলম। এর আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পরিচালকদের প্রতারণার খপ্পরে হোমল্যান্ড লাইফ’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করা হয়।
রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আদালত শুনানি শেষে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্সের গ্রাহকদের অর্থ লোপাটের অভিযোগ তদন্ত করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলে করতে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান ও দুদক চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, প্রথম শ্রেণির বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকসহ অনলাইন নিউজ পোটালে ইতিমধ্যে
হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালকসহ ‘টপ টু বটম’ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এসব দেখার দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রশাসনের রহস্যজনক নিরবতা সুযোগে এই প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসেছে।
এদিকে নিরুপায় হয়ে গত ৫ মার্চ হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের গ্রাহকদের ১০৪ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা দ্রুত তদন্ত এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে ১৪ গ্রাহকের পক্ষে রহিমা আক্তার নামের এক ভিকটিম হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন দায়ের করেছেন।
রিট আবেদনে বিবাদী করা হয়েছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ), দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান, হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ এই প্রতিষ্ঠানটির ১৪ পরিচালককে।
রিট আবেদনে হোমল্যান্ড ইন্স্যুরেন্সের অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে রুল জারির আবেদন জানানো হয়। পাশাপাশি গ্রাহকদের পাওনা টাকা দ্রুত ফেরতের বিষয়ে নির্দেশনাও চাওয়া হয়।
সূত্র মতে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পরিচালকদের প্রতারণার খপ্পরে হোমল্যান্ড লাইফ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে এ রিট আবেদনটি দায়ের করা হয়েছে। বোর্ড সভার কার্যবিবরণী জালিয়াতি, জমি কিনতে ভুয়া নথি তৈরি, কমিশন ও অন্যান্য খাতে খরচের ভাউচার তৈরি করে এসব টাকা আত্মসাত করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানের নামে অস্তিত্ববিহীন জমি কেনা হয়েছে। আবার সেই জমিতে মাটি ভরাট ও কাঁটাতারের বেড়া তৈরির নামে আরও অর্থ লোপাট করা হয়েছে।
অপরদিকে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালকদের মধ্যে ১২ জন পরিচালক যৌথ স্বাক্ষরে লিখিতভাবে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের দপ্তরে ওই প্রতিষ্ঠানে সংঘটিত নানা অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিপুল পরিমান অর্থ লোপাটের অভিযোগ দায়ের করেন।
পরিচালকরা অভিযোগের শুরুতেই উল্লেখ্য করেছেন , হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, আইন কর্মকর্তা ও হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তারা সকল ধরনের গ্রাহক লেনদেনে সম্পৃক্ত। বীমা গ্রাহক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শেয়ারহোল্ডাদের স্বার্থে কোম্পানির বিভিন্ন বিষয়ের প্রকৃত চিত্র বের করতে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যানের কাছে দায়ের করা আবেদন পত্রে স্বাক্ষর করেছেন হোমল্যান্ড লাইফের ভাইস চেয়ারম্যান জামাল মিয়া, পরিচালক আব্দুর রাজ্জাক, কামাল মিয়া, আবদুর রব, জামাল উদ্দিন, আব্দুল হাই, আব্দুল আহাদ, ফয়জুল হক,শামীম আহমদ,এমাদুল ইসলাম, স্বতন্ত্র পরিচালক শওকতুর রহমান ও ইশতিয়াক আহমেদ চৌধুরী। উক্ত আবেদনের অনুলিপি অর্থমন্ত্রী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বরাবরও পাঠিয়েছেন।
তারা অভিযোগ বলেছেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় হোমল্যান্ড লাইফের কেনা ১২০ কাঠা জমি গ্রাহকের দাবি পরিশোধে বিক্রয় করা হয়। কিন্তু সঠিকভাবে সম্পূর্ণ টাকা গ্রাহকের দাবি পরিশোধে ব্যয় করা হয়নি। গ্রাহকের টাকা পরিশোধ না হওয়ায় পরিচালকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা পর্যন্ত হয়েছে।
কয়েকজনের দুর্নীতির জন্য এই পরিচালকরা অসম্মানিত হয়েছেন উল্লেখ করে আবেদনে ( চিঠিতে) বলা হয়েছে, কোন কোন এরিয়ায় কোন কোন গ্রাহককে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, তার তালিকা এবং জমির বিক্রয়মূল্য সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয়েছে কি না? জমি ক্রয় এবং বিক্রয়ে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না বা একজন ব্যক্তির (পছন্দের ব্যক্তি) মাধ্যমে কেন সম্পূর্ণ জমি বিক্রয় করা হয়, তা তদন্তের মাধ্যমে দেখা দরকার।
জমি বিক্রয়ের টাকা কোন কোন অ্যাকাউন্টে কীভাবে জমা করা হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ বোর্ডে পেশ করা হয়নি এমন অভিযোগ করে এতে বলা হয়েছে, জমি বিক্রয়ে দাপ্তরিক ও অন্যান্য খরচ দেখিয়ে কোম্পানি থেকে কত টাকা বের করা হয়েছে এবং জমি বিক্রয় গেইন ট্যাক্স কীভাবে কত টাকা পরিশোধ করা হয়েছে, তার রশিদসহ প্রমাণাদি পেশ করা হয়নি।
অভিযোগে বলা হয়েছে, জীবন বীমা তহবিল হ্রাস পাওয়ার সঠিকতা নির্ণয় এবং বর্তমান কোম্পানির জীবন বিমা তহবিল কত তা উপস্থাপন করা হয়নি। আবার কোম্পানির কতগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে এবং বিগত পাঁচ বছর সব ব্যাংকের বিবরণী এফডিআর, বাংলাদেশ সরকারি টেজারী বন্ড সহ (বিজিটিবি) উপস্থাপন করা হয়নি।
কোম্পানির যেসব মামলা চলমান তার বিবরণ এবং প্রত্যেক মামলার বিপরীতে মামলার শুরু থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আইনজীবী ফি, দাপ্তরিক ও টিএ/ডিএ এবং অন্যান্য খরচ যৌক্তিক ভাউচার ছাড়াই এমডি, কোম্পানি সচিব ও আইন কর্মকর্তা জুবায়েরের স্বাক্ষরে বিপুল টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিচালকরা। একে ‘কোম্পানির টাকা কর্মচারী কর্তৃক আত্মসাৎ’ বলে মনে করছেন ওই পরিচালকরা।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, তথ্য আড়াল করে নিয়মবহির্ভূত অনেক টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। গত দুই বছরের বিভিন্ন ব্যয়ের বিপরীতে যে ভাউচার আছে, সেগুলো ওই সময়ের ব্যাংক স্টেটমেন্টের সঙ্গে যাচাই করলে জনগণের আমানত খেয়ানত করার প্রমাণ বের হয়ে আসবে।
এছাড়া আরজেএসসি-তে রিটার্ন জমা দেওয়ার দাপ্তরিক ও লিগ্যাল ফি বাবদ কত টাকা খরচ করা হয়েছে তার হিসাবের বৈধতা না থাকায় বিবরণী বোর্ডে পেশ করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেছেন এই পরিচালকরা।
তাদের অভিযোগ, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভুয়া শত শত কোটি টাকা ব্যবসা দেখিয়ে কমিশন, ইনসেনটিভ গ্রহণ ও কোম্পানির টাকায় ওমরাহসহ বিদেশ ভ্রমণ করে কোম্পানির অর্থ অপচয় করা হয়েছে। এ কারণে সঠিক পলিসি গ্রাহক অর্থের সংকটে সেবা পেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। ভুয়া ব্যবসা বা পলিসির জন্য নবায়ন প্রিমিয়াম না আসায় কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কোম্পানির ব্যবস্থাপনা ব্যয় অতিরিক্ত করার পাশাপাশি কোম্পানির টাকা দিয়ে হাতে কলমে ভুয়া ব্যবসা করা এবং কোম্পানির হিসাব বিভাগের কারসাজিতে ব্যবসা হাতে কলমে দেখানো হয় বলেও অভিযোগ তুলেছেন এই পরিচালকরা। তাদের দাবি, ডিসিএস ফাইলসহ যাচাই-বাচাই করলে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে।
কোম্পানির কতগুলো যানবাহন আছে এবং কোন যানবাহন কার নামে বরাদ্দ, কত টাকা বরাদ্দ ও প্রত্যেক যানবাহনের বিপরীতে বছরে কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে, তার বিপরীতে রেজিস্ট্রার নেই বলেও অভিযোগ করেছেন হোমল্যান্ড লাইফের পরিচালকরা। এর মাধ্যমে লাখ লাখ আমানতের টাকা লুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের। ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভুয়া ব্যবসা দেখিয়ে কোম্পানি থেকে বড় অঙ্কের টাকা সরিয়ে নেওয়া অভিযোগ আনা হয়েছে।
Posted ৯:৩১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৯ মার্চ ২০২৩
desharthonity.com | Rina Sristy