নিজস্ব প্রতিবেদক | বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪ | প্রিন্ট
ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কতিপয় অর্থলিপ্সু ব্যক্তির অনিয়ম-দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে একসময়ের লাভজনক ন্যাশনাল টি কোম্পানি (এনটিসি) এখন লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির চার সরকারি পরিচালকের দায়িত্বে অবহেলায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিধিবহির্ভূতভাবে শেয়ার বণ্টন করায়
সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কয়েকজন প্রভাবশালী শেয়ারধারীকে বিশেষ সুবিধা দিতে আনুষ্ঠানিকতা শেষ না করেই তড়িঘড়ি করে তাদের মধ্যে নতুন শেয়ার বণ্টন করা হয়েছে। কম দামে কেনা এসব শেয়ার বাড়তি দামে বাজারে বিক্রি করে বিপুল মুনাফার সুযোগ দিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। ফলে বঞ্চিত হয়েছে কোম্পানির অন্যতম মালিক সরকারি চার প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে সরকারি স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনোনীত পরিচালক নাভিদ শফিউল্লাহ, অর্থ মন্ত্রণালয় মনোনীত তৎকালীন পরিচালক মুন্সি আব্দুল আহাদ, আইসিবি মনোনীত পরিচালক মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও সাধারণ বীমা করপোরেশন মনোনীত পরিচালক মো. হারুণ-অর-রশীদ।
আর এই পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত থেকে কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও কোম্পানি সচিব মোল্লা গোলাম মোহাম্মাদ আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে এসব অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন করেছেন কোম্পানির এক বিনিয়োগকারী।
শেয়ার বণ্টন করা হয়েছে গত ২ অক্টোবর অথচ সেটি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে শেয়ারধারীদের জানানো হয় ৮ অক্টোবর। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্য সংবেদনশীল তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর বিধান থাকলেও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ তাদের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তিকে শেয়ার বিক্রির বাড়তি সুবিধা করে দিতে তা ছয় দিন পরে প্রকাশ করে।
কোম্পানিটির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মূলধন বাড়াতে এনটিসি প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যমান শেয়ারধারীদের মধ্যে নতুন ২ কোটি ৩৪ লাখ শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত নেয়। গত বছরের এপ্রিলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) বিষয়টি অনুমোদন করে। প্রতিটি শেয়ারের বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয় ১১৯ টাকা ৫৩ পয়সা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্য বা ফেসভ্যালুর সঙ্গে ১০৯ টাকা ৫৩ পয়সা অধিমূল্য বা প্রিমিয়ামসহ এ দাম নির্ধারণ করা হয়। প্লেসমেন্টের মাধ্যমে বিদ্যমান শেয়ারধারীদের মধ্যে একটি সাধারণ শেয়ারের বিপরীতে প্রায় তিনটি নতুন শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা ছিল, নতুন এই শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে ২৮০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে।
গত ৫ আগস্টের আগে এনটিসির মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির হোসেন। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শেয়ারের মালিকানা নিয়ে পরিচালক ছিলেন শেয়ারবাজার ও আর্থিক খাতের আলোচিত ব্যক্তি চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ও তার প্রতিনিধি আতিফ খালেদ। পরে শেয়ার কিনে মালিকানায় যুক্ত হন শিল্পপতি শওকত আলী চৌধুরী ও শিল্পোদ্যোক্তা নাদের খানের পরিবারের সদস্য ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। তবে বিপুল শেয়ারের মালিকানা থাকলেও তারা কোম্পানির পর্ষদে ছিলেন না। এমনকি কোম্পানির শীর্ষ পদের কর্মকর্তারাও ছিলেন নাফিস সরাফাতের পছন্দ করা ব্যক্তিরা।
নিয়ম অনুযায়ী, এনটিসির প্লেসমেন্ট শেয়ারের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ছিল ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত। এর মধ্যে গত ১৯ জুন থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে চাঁদা গ্রহণের কার্যক্রম। নির্ধারিত সময়ে ২৮০ কোটি টাকার বিপরীতে চাঁদা জমা পড়ে মাত্র ৫৪ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রত্যাশার মাত্র ১৯ শতাংশ। বাকি ৮১ শতাংশ শেয়ারধারী তাদের জন্য বরাদ্দ করা শেয়ারের জন্য চাঁদা জমা দেননি। এ কারণে কোম্পানির পর্ষদের পক্ষ থেকে মূলধন সংগ্রহ কার্যক্রমের সময় আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে আবেদন করা হয়। বিএসইসি সময় বাড়ানোর এ আবেদনের বিষয়ে তখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এনটিসির পর্ষদ থেকে পদত্যাগ করেন শেখ কবির হোসেন, নাফিজ সরাফাতসহ বিগত সরকারঘনিষ্ঠ বেশ কয়েকজন পরিচালক।
জানা যায়, প্লেসমেন্টের আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ হওয়ার আগেই যে ১৯ শতাংশ আবেদনকারী চাঁদা জমা দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ২ অক্টোবর শেয়ার বণ্টন করে দেয় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। কোম্পানির পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও কোম্পানি সচিব মোল্লা গোলাম মোহাম্মদ শেয়ার বণ্টনের এই সিদ্ধান্ত নেন। নতুন বরাদ্দ করা সাড়ে ৪৪ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক বা ২২ লাখ শেয়ার পেয়েছেন শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে জারান আলী চৌধুরী ও মেয়ে সাবাহ সামরিন। এর বাইরে শওকত আলী চৌধুরীর বেনামি প্রতিষ্ঠানও উল্লেখযোগ্য শেয়ার বরাদ্দ পেয়েছে। প্রতিটি শেয়ারের জন্য তারা বিনিয়োগ করেছেন ১১৯ টাকা ৫৩ পয়সা; আর কোম্পানিটির শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২৫৪ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি শেয়ারে মুনাফা হবে ১৩৪ টাকা। বাজারমূল্যে শেয়ার বিক্রি করলে শওকত আলী চৌধুরীর ছেলে ও মেয়ের মুনাফা হয় প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
ন্যাশনাল টির মালিকানার বড় অংশই ছিল সরকারের। সরকারের পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও সাধারণ বীমা করপোরেশন কোম্পানিটির প্রায় ৫১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করার কথা। ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এনটিসির বিশেষ সাধারণ সভা এবং ২০২৩ সালের ৮ এপ্রিল কোম্পানিকে দেয়া বিএসইসির লিখিত নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবসময়ই যৌথভাবে ৫১ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে হবে। কিন্তু নতুন শেয়ার ইস্যু হওয়ায় কোম্পানিটিতে সরকারি মালিকানার অংশীদারত্ব কমে মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এনটিসির বিগত পাঁচ বছরে সরকারি শেয়ার ধারণ হ্রাসের কারণ, শেয়ার বিক্রি যা হস্তান্তরের মাধ্যেমে উক্ত কোম্পানির মূলধন কাঠামোর উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের কারণ অনুসন্ধানে গত ১৭ অক্টোবর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
ফলে সরকারের বদলে কোম্পানিটিতে এখন বেসরকারি গুটিকয়েক ব্যক্তির মালিকানা নিরঙ্কুশ হয়ে গেছে। কোম্পানিটি এখন পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
যদিও সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়াতে বিএসইসি সাধারণ শেয়ারধারীদের চেয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে বেশি প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। সাধারণ শেয়ারধারীদের জন্য যেখানে বিদ্যমান একটি শেয়ারের বিপরীতে প্রায় তিনটি শেয়ার বরাদ্দ করা হয়, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটির বিপরীতে প্রায় সাড়ে চারটি শেয়ার বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকার মনোনীত চার পরিচালকের অনাগ্রহ ও দায়িত্বহীনতার কারণে সরকারের ৫১ শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। এছাড়া শেয়ার বণ্টনে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে পরিচালনা পর্ষদ এখন পর্যন্ত কোন ধরনের ব্যবস্থা না নেওয়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমানে কোম্পানির আর্থিক দৈন্যদশা চরম অবস্থায় পৌঁছেছে। ৬ সপ্তাহ ধরে মজুরি না পাওয়ায় কোম্পানির ১২টি বাগানের শ্রমিকরা ধর্মঘট করছে। তারা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করছেন। ফলে বাগানগুলোর উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পরিচালনা পর্ষদের সভা আহ্বান করতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনোনীত পরিচালক নাভিদ শফিউল্লাহ অনেক বিলম্বে সময় দেন। কোনো সভায় নাভিদ শফিউল্লাহ অনুপস্থিত থাকলে অন্য মনোনীত তিন পরিচালকও আসেন না। ফলে জরুরি সময়েও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সভা বিলম্বিত করার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনোনীত পরিচালক নাভিদ শফিউল্লাহ বলেন, “আমি একটি সভা পিছিয়ে দিয়েছি। কারণ সেসময় আমার আরেকটি মিটিং ছিল। সরকারের ৫১ শতাংশ শেয়ার সংরক্ষণে ব্যর্থতার বিষয়ে তিনি বলেন, প্লেসমেন্ট শেয়ারের টাকা জমা দেয়ার জন্য আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন বলতে পারছি না। শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপারে তিনি বলেন, সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে, তাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে। কৃষি ব্যাংকে যোগাযোগ করে ঋণ ছাড়ের অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ী থাকায় তারা আরও ঋণ দিতে অপারগতা জানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা পরিচালক হিসেবে যোগদানের পূর্বেই কোম্পানি লোকসান করে আসছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় মনোনীত পরিচালক মেহেদী মাসুদুজ্জামান কোম্পানির ৫১ শতাংশ শেয়ার ধারণে ব্যর্থতার বিষয়ে বলেন, ন্যাশনাল টি কোম্পানির মালিক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তারাই এ বিষয়ে বলতে পারবে। ১২টি চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি না পাওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অন্যায়, এ ব্যাপারে আপনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনোনীত পরিচালক নাভিদ শফিউল্লাহর সাথে যোগাযোগ করেন তিনি ভালো বলতে পারবেন।
বিনিয়োগকারীরা মনে করেন, সরকারের স্বার্থ ক্ষুন্ন করার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট চার মনোনীত পরিচালককে জবাবদিহিতার আওতায় আনার প্রয়োজন রয়েছে।
Posted ১২:৩১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪
desharthonity.com | Rina Sristy