নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট
বগুড়ায় হয়ে গেল ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। মেলার মূল আকর্ষণ বিশাল আকারের বাঘাইড় মাছ। তবে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট বাঘাইড় মাছকে মহাবিপন্ন ঘোষণা করায় গত দু্ই বছর যাবত মাছটি বিক্রি নিষিদ্ধ। মেলায় উঠানোর অনুমতি নেই। যে কারণে মেলায় বড় আকারের রুই, কাতল, মৃগেল, সিলভার কার্প উঠানো হয়েছে। এবারের মেলায় সর্বোচ্চ এক মণ ওজনের ব্ল্যাক কার্প উঠানো হয়েছিল।
জানা গেছে, গ্রামীণ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে গাবতলী উপজেলার মহিষাবার ইউনিয়নের ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ এলাকায় প্রতি বছর মাঘের শেষ বুধবার এ মেলার আয়োজন করা হয়।
কথিত আছে, প্রায় ৪শ’বছর পূর্বের এক সময়ে মেলা সংগঠনের স্থানে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল। একদিন হঠাৎ সেখানে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয়। তারপর সেখানে দলে দলে সন্ন্যাসীরা এসে একটি আশ্রম তৈরি করে। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়েরর কাছে সেটি একটি পূণ্যস্থানে পরিণত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে প্রতিবছর মাঘ মাস সমাপ্তের আগের অথবা শেষ দিনের পরের বুধবার (মাঘের শেষ বা পরের কাছাকাছি বুধবার) সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে। দুরদুরান্ত থেকে ভক্তরা প্রতি বছর সেই দিনটিতে এসে সমাবেত হতে থাকে। দিন গড়ানোর সাথে সাথে প্রতিবছর লোকসমাগম বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে পূজার দিনটিতে একটি গ্রাম্য মেলার গোড়াপত্তন হয়। এক সময় সন্ন্যাসীরা স্থানটি ত্যাগ করে চলে গেলেও হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাসী পূজাটি বন্ধ করে দেয়নি। ধীরে ধীরে মেলাটির পরিচিতি বাড়তে থাকে। দূর দূরান্ত থেকে মেলা দেখতে লোকজন আসতে শুরু করে। পূজা পার্বণ মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও এই মেলা ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে সব ধর্মের মানুষকে উৎসবে একত্র করে। এখন সন্ন্যাসী পূজাটি চালু থাকলেও সকল ধর্মের হাজার হাজার মানুষ মেলাতে এসে উপস্থিত হয়।
এদিকে, পোড়াদহ মেলার মূল আকর্ষণ বিশাল আকারের মাছের পরের স্থানেই রয়েছে বড় আকার এবং বিভিন্ন আকৃতির মিষ্টি। এছাড়া নাগরদোলা, সার্কাসসহ ছোট বাচ্চাদের বিভিন্ন রাইড মেলায় নিয়ে এসেছেন মেলা কর্তৃপক্ষ।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, নারী শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ মেলায় এসেছেন। মেলায় আগত অধিকাংশের বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কিনতে দেখা গেছে।
মেলায় আগতরা জানান, মেলাটা স্থানীয় এবং আশপাশের গ্রামের লোকদের কাছে বড় উৎসবের। এ কারণে প্রতি বছর এই মেলাকে ঘিরেই তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং আয়োজন করে থাকেন। দূর দূরান্ত থেকে আত্মীয় স্বজনদের তারা দাওয়াত দেন আজকের দিন। ফলে বাড়িতে বাড়িতে মেহমান দিয়ে ঠাসা থাকে। মেলাকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় প্রতিটি বাড়িতে প্রায় ১০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। কেউ কেউ ৫০ হাজার বা তারও বেশি খরচ করেন এই দিনে।
বগুড়ার ফুলবাড়ী এলাকা থেকে মেলায় গিয়েছেন রেজাউল ইসলাম। মেলার পাশের মহিষাবান গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি। তিনি বলেন, দশ বছর হয়েছে আমার বিয়ে। প্রত্যেকবার মেলায় দাওয়াত পাই। যত কাজ থাকুক, আমাদের আসতে হয় মেলায়। মেলা উপলক্ষে আমরা মাছ-মাংস ও মিষ্টি কিনি। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
গাজীপুর থেকে মেলায় আসা মাসুদ রানা বলেন, আমার শ্বশুরবাড়ি সারিয়াকান্দি উপজেলায়। মেলার কথা অনেক শুনেছিলাম। এবার এসে দেখলাম। আগে কখনও এত বড় মেলা দেখিনি।
এদিকে, মেলা ঘুরে এবার ৪০ কেজি ওজনের ব্ল্যাককার্প জাতের মাছ দেখা গেছে। মাছটি এনেছেন বজলুর রশিদ নামে মাছ ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, নাটোরের বিল থেকে আনা হয়েছে মাছটি। তিনি মাছটির দাম চেয়েছেন প্রতি কেজি ২ হাজার টাকা।
মাছ ব্যবসায়ী মুছা জানান, এবার মেলায় মাছের দাম বেশি। এ জন্য বড় মাছের ক্রেতা কম। তবে বাগাইড় মাছ থাকলে কার্প জাতীয় মাছের দাম কম পেত ক্রেতারা। বড় আকারের বিগহেড, কাতল, রুই এগুলো এক হাজার টাকা কেজি দামে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া মাছ ব্যবসায়ীরা জানান, মেলায় আইড় মাছ দুই হাজার টাকা, চিতল ও বোয়াল ১৫শ টাকা করে দাম চাওয়া হচ্ছে। ছোট সাইজের সিলভার কার্প ৪০০, গ্রাস কার্প ২৫০, বিগহেড ৮৫০-৪৫০ দাম হাঁকাচ্ছেন বিক্রেতারা।
এদিকে, এক ব্যবসায়ী কয়েকটি বাঘাইড় মাছ মেলায় নিয়ে আসেন। পরে বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের অভিযানে মাছগুলো জব্দ হয়। অভিযানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে গাবতলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আফতাবুজ্জামান আল ইমরান।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গাবতলী থানার ওসি সনাতন দাস বলেন, আদালতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ৬০ হাজার টাকা মূল্যের চারটি বাগাড় মাছ জব্দ করেন। এই মাছ বিক্রয়ের চেষ্টার জন্য শুক্রা সাকিদার নামে ব্যবসায়ীকে ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। এছাড়া তিনি বলেন, মেলার আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে তৎপর তারা।
Posted ৮:৩৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
desharthonity.com | Rina Sristy