নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩ | প্রিন্ট
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
এই বাজেটে কিছু পণ্যে আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট অথবা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে লেখার কলম থেকে শুরু করে ফেসিয়াল টিস্যু, টয়লেট টিস্যু, সিমেন্ট, কাজু বাদাম, বাসমতি চাল, চশমা, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, প্লাস্টিকের পাত্র, অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্র, সিগারেট, জর্দা-গুল, খেজুর, বিদেশি টাইলস ও মোবাইল ফোনসহ বেশকিছু নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম আগামী দিনে আরও বাড়তে পারে।
শুধু নিত্যপণ্যই নয়, আগামীতে সংসার খরচের পাশাপাশি বাড়তে পারে ভ্রমণ খরচও। কারণ, নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিমানের টিকিটের ওপর ভ্রমণ কর বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩ টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। এটি বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের পঞ্চম বাজেট, টানা ১৫তম এবং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পঞ্চম বাজেট।
যেসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে:
কলম: শিক্ষার্থীদের লেখার প্রধান উপকরণ কলমের দামও নতুন অর্থবছরে বাড়তে পারে। কলম উৎপাদনে বর্তমানে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, সেখানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। কারখানা থেকে বাজারে কলম সরবরাহের সময় এই কর আরোপ করা হবে। এতে কলমের দাম বাড়তে পারে।
চশমার ফ্রেম ও সানগ্লাস: ফ্রেম ও সানগ্লাস আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ এবং উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে সামনে এসব পণ্যের দামও বাড়তে পারে।
দামি গাড়ি: আগামী অর্থবছরের বাজেটে দামি গাড়ির ওপর নতুন করে আরোপ হতে পারে। ফলে বাজেটে দামি গাড়ি আরও দামি হতে পারে। ২০০১ সিসি থেকে ৩০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ি আমদানিতে এখন ২০০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসে, যা বাড়িয়ে ২৫০ শতাংশ এবং ৩০০১ থেকে ৪০০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ৩৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে ৫০০ শতাংশ করা হতে পারে। ২০০০ সিসির বেশি ইঞ্জিন ক্ষমতাবিশিষ্ট গাড়ি সাধারণত জিপগাড়ি হয়। এখন দেশে বিপুলসংখ্যক জিপগাড়ি কিংবা এসইউভি মডেলের গাড়ি আসছে। জনপ্রিয় হচ্ছে জিপগাড়ির ব্যবহার। টয়োটা, মিতসুবিশি, নিশান, টাটাসহ নানা খ্যাতনামা কোম্পানির গাড়ির ব্যবহার বাড়ছে।
নির্মাণ সামগ্রী: বাড়ি নির্মাণের প্রধান উপকরণ সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিঙ্কার আমদানিতে বর্তমানে টনপ্রতি ৫০০ টাকা শুল্ক রয়েছে, নতুন অর্থবছরে এটি বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হচ্ছে। এ কারণে সিমেন্টের দাম বাড়তে পারে। বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত বিদেশি টাইলস আমদানিতে রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে বিদেশি টাইলসের দামও বাড়তে পারে।
ভূমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন: রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ) এলাকায় জমি নিবন্ধনের ট্যাক্স বিদ্যমান ৩ শতাংশ ও ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে যথাক্রমে ৪ শতাংশ ও ৫ শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া ফ্ল্যাট বিক্রিতে বিদ্যমান গেইন ট্যাক্স বাড়তে পারে। ফলে আগামী অর্থবছর থেকে উভয় ক্ষেত্রে বাড়তি খরচ গুনতে হবে।
সিগারেট: বাড়তি বাজেট বরাদ্দ করতে হবে ধূমপায়ীদের। কারণ প্রস্তাবিত বাজেটে সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে নিম্নস্তরের এক প্যাকেট (২০ শলাকার) সিগারেটের (যেমন-হলিউড, ডার্বি) দাম ৯০ টাকা, মধ্যম স্তরের (স্টার, নেভি) ১৩৪, উচ্চস্তরের (গোল্ডলিফ) ২২৬ এবং অতি উচ্চস্তরের (বেনসন, মার্লবোরো) সিগারেটের দাম ৩০০ টাকা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে জর্দা-গুলের দামও। তবে বিড়ির দাম অপরিবর্তিত থাকবে।
বাসমতি চাল: নতুন অর্থবছরে বাসমতি চাল আমদানিতে ভ্যাট বসানোর হয়েছে। ফলে বিরিয়ানি-তেহারির অন্যতম প্রধান উপকরণ এ চালের দাম আরও বাড়বে। এতে যারা শখ করে উৎসব-পার্বণে বিরিয়ানি বা তেহারি খেতে পছন্দ করেন, খরচ বাবদ তাদের গুনতে হবে বাড়তি টাকা।
খেজুর ও কাজুবাদাম: সুস্বাস্থ্যের জন্য কাজুবাদাম অনেকের কাছেই জনপ্রিয়। দেশে বাদাম চাষকে উৎসাহিত করতে কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই আমদানি করা কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে। এ ছাড়া নতুন অর্থবছরের বাজেটে তাজা ও শুকনা খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্কের পাশাপাশি ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
তৈজসপত্র ও গৃহস্থালি সামগ্রী: বাড়তি অর্থ গুনতে হবে প্লাস্টিকের তৈরি সব ধরনের টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালি সামগ্রীতেও। কারণ এসব পণ্যের উৎপাদনে ভ্যাট বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে এসব পণ্যের উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে।
এ ছাড়া অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি গৃহস্থালি সামগ্রী ও তৈজসপত্রের (হাড়ি-পাতিল, থালা-বাসন) ক্ষেত্রেও ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু/পকেট টিস্যু ও পেপার টাওয়াল উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে আগামীতে এসব পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।
শুল্ক ফাঁকি রোধে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সব ধরনের ওভেন আমদানির শুল্ক ৩০ শতাংশ বাড়িয়ে মোট করভার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিদেশি ওভেনের দাম বাড়তে পারে। অবশ্য দেশে ওভেন উৎপাদনের ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা দেওয়া আছে। ফলে বিদেশি ওভেনের দাম বাড়লেও দেশি ওভেনের দাম না-ও বাড়তে পারে।
সিলিন্ডার: বর্তমানে সারাদেশে রান্নার কাজে এলপি গ্যাস সিলিন্ডার ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়। প্রস্তাবিত অর্থবছরের বাজেটে সিলিন্ডার উৎপাদনে ব্যবহৃত স্টিল ও ওয়েল্ডিং ওয়্যার আমদানিতে শুল্ক আরোপ এবং উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে আগামীতে রান্নার চুলার জন্যও গুনতে হবে বাড়তি টাকা।
মোবাইল ফোন: মোবাইল ফোনকে বিলাসী পণ্য বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট আরোপের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি আছে, সেখানে ২ শতাংশ ভ্যাট বসানো হচ্ছে। আর সংযোজন পর্যায়ে ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে মোবাইল ফোনের দাম বাড়তে পারে।
সাইকেল: নতুন অর্থবছরে সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিরিশ কাগজ আমদানিতেও শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। ভাঙা জিনিস জোড়া দেওয়ার আঠা বা সুপার গ্লু সংরক্ষণমূলক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব হয়েছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়তে পারে।
বিমানের টিকিট: শুধু নিত্যপণ্যই নয়, আগামীতে সংসার খরচের পাশাপাশি বাড়বে ভ্রমণ খরচও। কারণ, নতুন অর্থবছরের বাজেটে বিমানের টিকিটের ওপর ভ্রমণ কর বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আবার অধিক সংখ্যক মানুষকে করজালের আওতায় আনতে এবার শূন্য আয় (করযোগ্য সীমার নিচে বার্ষিক আয়) দেখিয়ে রিটার্ন জমার স্লিপ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) নিতে ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আরোপের পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার।
এবারের বাজেটের মূল দর্শন হলো- ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এই স্লোগান নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। নতুন এ বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এতে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখার কথা বলা হচ্ছে।
Posted ৮:৪৩ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০১ জুন ২০২৩
desharthonity.com | Rina Sristy