নিজস্ব প্রতিবেদক | বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ | প্রিন্ট
রাজিয়া খান প্রখ্যাত বাংলাদেশি সাহিত্যিক। লেখালেখি ছাড়াও তিনি দীর্ঘদিন মঞ্চে অভিনয় করেছেন। তাঁর পুরো নাম রাজিয়া খান আমিন হলেও তিনি রাজিয়া খান নামে লেখক হিসেবে পরিচিত।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
রাজিয়া খান ১৯৩৬ সনের ১৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তমিজউদ্দিন খান অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী, আইন সভার সদস্য এবং জাতীয় পরিষদের স্পিকার ছিলেন। তিনি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে কারাভোগ করেন। মাতা রাবেয়া রাহাত খান।
পারিবারিক জীবন
ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক পরিবেশ রাজিয়া খানের মধ্যে প্রগতিবাদী চেতনা গড়ে উঠতে সাহায্য করে। পরবর্তীতে সাংসারিক জীবনেও তিনি সে ধারা বজায় রাখেন। রাজিয়া খানের স্বামী আনোয়ারুল আমিন ব্যাংকার ছিলেন। এক ছেলে কায়সার তামিজ আমিন ও এক মেয়ে আশা মেহরিন।
শৈশব কাল
কলকাতায় ছিলেন ১০ বছর। তখন তার বয়স দশ বছর। শৈশবের সেই স্মৃতি, কলকাতার সেই রূপ তার লেখায় বারবার ফিরে এসেছে। সেই সময় কলকাতা ছিল বিরাট মেট্রোপলিটন শহর, কলকাতা শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গন ছিল বিশাল উদার। মুসলমান হিন্দুর বিভেদ তখনও তৈরি হয়নি। বৃটিশরা নানা ধরনের জটিলতা তৈরি করলেও সাধারণ মানুষের জীবনে তখনও তার কোনো প্রভাব ছিল না। খুব স্বাভাবিকভাবেই কলকাতার সেই উচ্ছল জীবন তার শৈশবে প্রভাব ফেলেছিল এবং তিনি সারাজীবন সেই আনন্দময় স্মৃতি মনে রেখেছেন।
শিক্ষা জীবন
রাজিয়া খান কলকাতা ও করাচিতে স্কুল, কলেজ জীবন সমাপ্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম হন। ব্রিটিশ কাউন্সিলের স্কলারশীপ নিয়ে ইংল্যান্ডে পড়তে যান। সেখান থেকে তার পিএইচ.ডি. ডিগ্রির সব কাজ সমাপ্ত করে কলকাতায় আরও কিছু রিসার্চ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন।
কর্মজীবন
এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পর তিনি কর্মজীবনের শুরু করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে ইংল্যান্ড থেকে ফিরে তিনি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে যোগ দেন। পাশাপাশি কাব্যচর্চার গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। এখানে তার লেখা ব্যঙ্গ কলাম—‘কালচার কেটল’ তীক্ষ্ণ লেখনীর জন্য জনপ্রিয় হয়।
১৯৫৮ সাল থেকে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয় পুনরায় শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করেন এবং এই বিভাগের প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি দেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন সংবাদপত্রে সাংবাদিক ও সম্পাদক রূপে কাজ করেছেন। ড. রাজিয়া খান ইউনিভাসিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এ ইংরেজি বিভাগের ডিন হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
সাহিত্য কর্ম
রাজিয়া খান পঞ্চাশ দশকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুরাগী ও প্রগতিবাদী লেখিকা হিসেবে সাহিত্যের অঙ্গনে এগিয়ে আসেন। লেখিকা হিসেবে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। মূলত কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরে উপন্যাসিক হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৮ বছর বয়সে লেখা ‘বটতলার উপন্যাস’ ব্যাপকভাবে সাহিত্যাঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তার মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্রৌপদী’ এপার ওপার দুই বাংলায় সমাদৃত। তার জনপ্রিয় বই ‘বটতলার উপন্যাস’ (১৯৫৯) ও ‘অনুকম্প’ (১৯৫৯)। যে উপন্যাসগুলো এক সূত্রে গ্রথিত তার নাম প্রতিচিত্র (১৯৭৫), ‘চিত্রকাব্য’ ও ‘উপসংহার’। অন্যান্য বই—‘অনুকম্প’, ‘Argus under Anaesthesia, cruel April,‘ ‘সোনালী ঘাসের দেশ’ (বাংলা কবিতা), ‘চিত্রকাব্য’, ‘হে মহাজীবন’, ‘নোংরা নাটক: তিনটি একাঙ্কিকা’, ‘আবর্ত’ (পি.ই.এন. পুরস্কৃত নাটক), ‘তমিজুদ্দিন খানের আত্মকথা’ (বাংলা অনুবাদ)। ‘দ্রৌপদী’, ‘পাদবিক’, ‘Multi Dimensional vision in George Eliot, A Different spring৷ ‘, জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ।
মঞ্চে অভিনয়
মঞ্চ অভিনয়ে এক সময় রাজিয়া খানের দৃপ্ত পদচারণা ছিল। মাত্র ১৪/১৫ বছর বয়সে নাটক ‘পাগল হাওয়া’য় অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি মঞ্চে কাজ শুরু করেন। এরপর ‘বিজয়া’ নাটকে মালিনী’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। স্কটরস ক্লাবের নাটকে। মুনীর চৌধুরী ছিলেন ‘বিলাসবিহারী’। এরপর মঞ্চের সঙ্গে জড়িয়ে যান। অভিনয় করেন ‘নীলদর্পন’, ‘মেঘমুক্তি’, ‘দুইপুরুষ’, ‘বিদ্রোহী পদ্মা’য় ৷ ‘কৃষ্ণকুমারী’তে অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চ অভিনয়ের ইতি টানলেও সত্তরের দশকে ইংরেজী ‘রক্তকরবী’তে অভিনয় করেন।
‘এছাড়াও বেতারের ভার্সিটি ম্যাগাজিনে ‘Oliver Twist, Anthony & Cleopatra, Antigone‘ এবং ‘Mid-Summer Nights Dream –‘ এ অভিনয় করি’ – বললেন রাজিয়া খান।
চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা
রাজিয়া খান চলচ্চিত্র অঙ্গনের সঙ্গেও দীর্ঘ দিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আসীন ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম দীর্ঘদিন। আমার ‘Youth Film Society’ -র সেক্রেটারী ছিল বর্তমানের শিল্পপতি আজম চৌধুরী। চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি, চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটি, সেন্সর বোর্ডে ছিলাম অনেক দিন।’
ভ্রমণ
ড. রাজিয়া খান অনেকবার যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, মালয়েশিয়া, মায়ানমার, মিশর, হংকং জাপান, ভারত, সিঙ্গাপুর ও আরব দেশ সফর করেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ। ১৯৭৮ সালে দিল্লীতে কমনওয়েলথ লেখক সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের কবিতা’ শীর্ষক ইংরেজী প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯০৫ সালে ভেনিসে পি.ই.এন সম্মেলনে প্রবন্ধ পাঠ করেন। এছাড়া ১৯৮৪ সালে চীন সরকারের আমন্ত্রণে চীনে যান।
পুরস্কার ও সম্মাননা
রাজিয়া খান তার সাহিত্য কর্মের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ‘আবর্ত’ নাটকটি পি.ই.এন. পুরস্কার প্রাপ্ত হয়। ১৯৯৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয় (শিক্ষার জন্য)। রাজিয়া খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট কার্যকরী সংসদ, ফিল্ম সেন্সর বোর্ড, জাতীয় চলচ্চিত্র বিচারক কমিটির সদস্য এবং রোকেয়া হলের প্রভোস্ট (১৯৭৭) ছিলেন। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ফেডারেশনের সহসভাপতি হিসেবে পর্তুগালে চলচ্চিত্র উত্সবে বিচারকও নির্বাচিত হন। তিনি বহু সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষক ও বাংলা একাডেমির ফেলো ছিলেন।
মৃত্যু
রাজিয়া খান ২০১১ সালের ২৮ ডিসেম্বরে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।
Posted ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
desharthonity.com | Rina Sristy